বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখন বিপদজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে শুধু ঢাকা নয় পুরো দেশকেই লকডাউন করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেয়া লকডাউনের কারণে অনেক মানুষেরই যে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়া, সেটার পেছনে মূল কারণ লকডাউনে কর্মহীনতা কিংবা উপার্জন কমে যাওয়া।

আর এই পরিস্থিতি যে শুধুমাত্র দেশের গ্রাম এলাকাগুলোতে দেখা যাচ্ছে এমনটা নয়, বরং শহরগুলোতেও দেখা যাচ্ছে এই একই দৃশ্য। সম্প্রতি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে লকডাউনে দেশের মানুষের এমনই অর্থাভাবের চিত্র।

রাজধানীর বেগুনটিলা বস্তির বাসিন্দা জুলেখা বেগম করোনা ভাইরাসের আগেও কাপড়ের ব্যবসা করে মাসে গড়ে ৮ হাজার টাকা আয় করলেও লকডাউনের মরণ থাবায় আজ পুঁজি আর অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই নারী। জীবন বাঁচাতে এখন কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে বাসা বাড়িতে কাজ করছেন জুলেখা। আর এই কাজ করে বর্তমানে জুলেখার আয় মাসে ৩ হাজার টাকা। বিবিসি বাংলাকে এই নারী বলেন, ‘আগে যখন ব্যবসা ছিল নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতাম। যখন ইচ্ছা হতো ব্যবসায় যেতাম। ইচ্ছা না হলে বাসায় থাকতাম। এখন খাওয়া নাই, টাকা নাই। কষ্ট করে জীবন চলছে। মাসে ৩ হাজার টাকা আয় করি। এই টাকায় ছেলে মেয়ে পড়াবো নাকি সংসার চালাবো, বুঝতে পারছি না।’

এদিকে কথা হয়, মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের সরস্বতী রানীর সাথে। কয়েকবছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রের উপার্জনে তার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু দুই দফা লকডাউনে স্থানীয় একটি সেলুনে কাজ করা ছেলে কর্মহীন হয়ে পড়ায় সংসারে সেই যে বিপর্যয় তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি সরস্বতী রানী। তিনি বলেন, ‘লকডাউনে ছেলে চাকরি হারানোর পর গরীব হয়ে গেছি। ঘরে খাবার থাকেনা। ঋণের টাকা দিতে পারছি না। খুবই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে।’ দুঃখ করে সরস্বতী বলেন, ‘অভাবের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারিনা। দু’মুঠো খেতে বসলে যখনই এগুলো চিন্তা মাথায় আসে, আর খেতে পারিনা।’

cover
সরস্বতী
cover
জুলেখা
সরস্বতী রানীর মতো অনেকে জানে না আবার কবে পূর্বের মতো ফিরে আসবে সংসারের শান্তি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ও পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার) এর হিসেবে, করোনাভাইরাসের মহামারীতে সরস্বতী-জুলেখার মতো যারা নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে তাদের সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২৪ লাখ। তবে এই বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনো হিসেব নেই। যদিও সরকারের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস জানিয়েছে, ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার যে ২৪ শতাংশ ছিল পরবর্তী বছরগুলোতে তা ১৮ শতাংশের নিচে চলে এলেও করোনাভাইরাসের প্রভাবে তা আবার ২৪ শতাংশের উপরে চলে গেছে। তাদের হিসেবে গেল ৬ মাসে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৯ লাখ।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ- এর সিনিয়র রিসার্চার এস এম জুলফিকার আলী বলেন, ‘৬ শতাংশ এই মাত্রা যে আমরা ধরে রাখতে পারিনি এটার প্রধান কারন করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নেয়া এই লকডাউন। এখন সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ তারা কিভাবে এটা সামলাবে।’ দারিদ্র্যতা মোকাবেলায় সরকারের চিন্তাধারাগুলো নিয়ে বিবিসি বাংলার সাথে কথা বলেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘সরকার অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। অনলাইনে দরিদ্রদের মাঝে ২৫০০ টাকা পাঠানো, কম মূল্যে চাল দেয়া, কার্ডের মাধ্যমে চাল দেয়া-ইত্যাদি নানা উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এই বিপর্যয় সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করছি, আমাদের কৌশল কাজ করছে এবং মানুষরা নিজেও এটি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে। সকলে কাজে ফিরে গেছেন।’

cover
পরিকল্পনামন্ত্রী
সরকার কর্তৃক দরিদ্র মানুষের মাঝে নগদ অর্থায়ন ও সকলের কাজে ফিরে যাওয়ায় দারিদ্র্যতা কমছে- পরিকল্পনামন্ত্রী এমনটা মনে করলেও বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকার কর্তৃক দেয়া নগদ অর্থায়নের তালিকায় দেশের সব দরিদ্র মানুষকে যেমন রাখা হয়নি, তেমনি লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া অনেক মানুষ এখনও নতুন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। তাই নতুন বছরে দারিদ্র্য মোকাবেলার চ্যালেঞ্জটা আরও বড়।